মানসিক স্বাস্থ্য

২০২০ এ নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের পেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন, অপ্রত্যাশিত! কোভিড-১৯ এর কারণে করোনাক্রান্ত পৃথিবীতে ‘স্বাস্থ্য’ যখন শিরোনাম, তখন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থায় লক্ষ কোটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর অভূতপূর্ব প্রভাব ফেলছে। আমরা জানি যে উদ্বেগ, ভয়, বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক দূরত্ব এবং বিধিনিষেধ, অনিশ্চয়তা মানসিক দুর্দশার মাত্রাগুলি ব্যাপকভাবে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তুলছে। এই কঠিন ও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবার ১০ অক্টোবর পালিত হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ এর উদ্যোগে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়। তবে এবারে মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে অর্থনৈতিক ভাবনা ও টেকশসই উন্নয়নের বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে। উন্নয়নওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০১৮ এর প্রতিবেদনে বলছে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধিগুলি বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং যদি সম্মিলিতভাবে ব্যর্থতার সমাধান না করা হয় তবে ২০১০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হতে পারে। আমরা একটি আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছি এবং এই আসন্ন বিপর্যয়ে বিগত দুই দশক ধরে আগে থেকেই আগে থেকেই আগে থেকে আগত হয়েছিল। এটি এই সময়ে মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন এবং মানসিক স্বাস্থ্য হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা দ্বারা আরও জটিল হয়েছে। তাই এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য, বৃহত্তর বিনিয়োগ- বৃহত্তর সুযোগ’।

গত বছর এই দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানসিক সাস্থ্যের উন্নয়ন, আত্মহত্যা প্রতিরোধ’। প্রতিবেদন মতেমাত্র ৪০ সেকেন্ডের ব্যবধানে ঘটছে আত্মহত্যা। বছরে ৮ লক্ষ মানুষ অত্মহাত্যায় মারা যাচ্ছে। আর ৭৮ শতাংশ আত্মহত্যা ঘটে আমাদের মতন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। তরুণদের মধ্যে আবার আত্মহত্যার প্রবণতা প্রবল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০ শতাংশ তরুণ বিভিন্ন মানসিক রোগে ভোগে। কৈশোর-তারুণ্যে আত্মহত্যা হচ্ছে বিশ্বে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ। ক্রমশই তরুণদের মাঝে বাড়ছে অধৈর্য,অস্থিরতা, সহিংসতা, আত্মহত্যার ঝোঁক, মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন মানসিক রোগ। গ্যাং কালচার, ডিজে পার্টিসহ নানান রকম নিত্যনতুন চর্চা ও প্রবণতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ছে তারা। যাদের মানসিক রোগ হয়, তাদের ৫০ শতাংশের ওই রোগের প্রথম লক্ষণ ১৪ বছরের মধ্যেই দেখা দেয়।

পরিবার, দাম্পত্য জীবন বা প্রেমের সম্পর্কে সামান্য মানসিক আঘাত পেলে, আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হলে বা অপরকে ম্যানপুলেট করতে তারা হাত কেটে ফেলে, ঘুমের ওষুধ খায়, ক্ষতিকর কিছু গলাধঃকরণ করে, শরীরের অংশবিশেষ পুড়িয়ে ফেলে ইত্যাদি। আমাদের এই অজ্ঞতা ও অসচেতনতা কাটিয়ে উঠতে হবে, কেননা জীবনকে সুন্দর, সার্থক, সুখী করতে হলে শৈশব থেকেই ভালো মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে।পেশাগত পর্যায়ে এসেও কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবেশ, মনঃসামাজিক চাপ কর্মদক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তির কর্মক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ ও জটিল কাজ যেমন মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে, তেমনি কম কাজ বা সেখানে ব্যক্তির দক্ষতা ঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলেও সেটা হীনমন্যতা সৃষ্টি করে। এ বিষয়গুলো তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০১৭ সালের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছিল ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, মনঃসংযোগ না করতে পারা, কাজে অনুৎসাহ, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়াসহ নানা নেতিবাচক মানসিক চাপ শারীরিক অনেক উপসর্গ হিসেবেও প্রকাশিত হতে পারে। যেমন মাথাব্যথাসহ শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা, পেটে সমস্যা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বমি বমি ভাব, ঘুমে সমস্যা। শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে ব্যক্তি কাজে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

সময়মতো কাজ সেরে উঠতে না পারা অথবা কাজ দীর্ঘ সময় ধরে ফেলে রেখে করা যদি নিত্যকার অভ্যাস হয়ে দাড়ায় তাহলে মানসিক স্বাস্থের দিকে নজর দেবার বিষয়। বেশি সময় ফেলে রেখে কাজ শুরু করার ফলে কাজের প্রতি আগ্রহ কমে আসে। ফলে কাজের মান খারাপ হয়। আবার যে কাজটা ফেলে রাখা হয়েছে তা সারাক্ষণ মনের মধ্যে একপ্রকার অস্থিরতা তৈরি করে, যার ফলে অন্য কাজও সুন্দরভাবে করা যায় না। শুরুতে তেমন সমস্যা না হলেও ধীরে ধীরে এটি মারাত্মক সমস্যায় রূপান্তরিত হতে পারে। কর্মদক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসতে পারে শূন্যের কোঠায়। তাছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অবিবেচক আচরণ, কর্তৃত্বমূলক খবরদারি ও অসহযোগী মনোভাব বাড়তি মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় সূক্ষ্ম সমালোচনা, অশোভন মন্তব্য, যৌন হয়রানি, ব্যক্তিগত বিষয়ে অহেতুক নাক গলানো ইত্যাদি বিষয়গুলোও মানসিক উদ্বেগ, বিষন্নতা বাড়িয়ে দেয়। হৃদযন্ত্রে আগাত হানে।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে গড়ে ৩৬ কর্মদিবস বিষন্নতার কারণে নষ্ট হয়। ফলে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি বা সময়মতো না আসা, কাজের গুণগত মান কমে যাওয়া, সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারা, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, কাজে প্রায়ই ভুল করা, মনে রাখতে না পারা বা সহকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার ফলে আচার-আচরণ বা ব্যবহারের দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়। এসব অবনমন প্রতিরোধে আগে থেকেই সচেতন থাকা, সচেতন রাখা জরুরি। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য ঝুকি বিচেনায় আনা প্রয়োজন। শৈশব, কৈশোর থেকে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষঠানের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নেওয়া নিশ্চিত করতে পারলে পরিণত বয়সে এসব সমস্যা অনেকখানি মোকাবেলা করা সম্ভব। আমেরিকায় নিউইয়র্কে ‘মেন্টাল হেলথ এডুকেশন ইন স্কুলস ল’ আইন পাসের মাধ্যমে নিউইয়র্কের কিন্ডারগার্টেন থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে স্কুল-কলেজ থেকেই ‘সোশ্যাল ইমোশনাল লার্নিং’ (এসইএল) শেখানো হয়। এতে থাকে আত্মসচেতন হওয়ার শিক্ষা; নিজেকে সামলানোর কৌশল; সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি; সম্পর্ক ও যোগাযোগ-দক্ষতা; দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা।

আমাদের দেশেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে স্থান দিতে হবে। শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতির পাশাপাশি টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলে মানসিক সাস্থ্য পরিচর্যা অনুষ্ঠান সরাসরি করা হলে বা সভা সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করলে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়বে। মানুষের মধ্যে সংকোচ দূর হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেনা। বিশেষ করে করোনার কারণে নতুন পরিবর্তিত পৃথিবীতে খাপ খাইয়ে নিতে মানসিক দৃঢ়তা ও একইসাথে শিথিল মনোভাব দরকার তা তরানিন্বত হবে বলে প্রত্যাশা করি। নাজমুল হুদা আত্মোন্নয়নমূলক লেখক, গবেষক ও উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকwww.nazmul-h.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *